কোথাও ২০ মিনিট, কোথাও ১০ মিনিট। এভাবে নগরীর দেওয়ানহাট থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত প্রতিটি মোড়ের সিগন্যালে আটকে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। শেষ গন্তব্যে যেতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। অথচ পথটা মাত্র ১৬ কিলোমিটারের। বিশেষ করে অফিস-আদালতে আসা-যাওয়ার সময় ভোগান্তি হয় সবচেয়ে বেশি। লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় দুথপাশের রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। একইসাথে রাস্তায় ওয়াসার খোঁড়াখুড়ি, বিদ্যুৎ বিভাগের কাজও প্রতিনিয়ত চলছে। তাই এ সড়কের যাত্রীদের নিত্য ভোগান্তি যেন পিছু ছাড়ছে না।
এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলমান থাকায় আগ্রাবাদ, বারেকবিল্ডিং, ইপিজেড ও সিমেন্ট ক্রসিংসহ কয়েক জায়গায় যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। যার প্রভাবটা পড়ছে দেওয়ানহাট পর্যন্ত। আবার আগ্রাবাদ, বারেকবিল্ডিং, ৩নং বন্দর জেটি ফকিরহাট, নিমতলা বিশ্বরোড, সল্টগোলা ক্রসিংয়ে একপাশের গাড়ি পাস করার জন্য অন্যপাশ বন্ধ রাখতে হচ্ছে ট্রাফিক বিভাগের। দুথপাশে রাস্তা ছোট হওয়ায় একটা গাড়িকে ওভারটেক করে অন্য গাড়িও যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে যাত্রীদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
গতকাল বুধবার নগরীর চৌমুহনী এলাকায় অবস্থানকালে দেখা গেছে, আগ্রাবাদ অভিমূখে গাড়ি না যাওয়ায় চৌমুহনী এলাকায়ও সিগন্যাল দিয়ে যানবাহন দাঁড় করিয়ে রেখেছেন কর্মরত ট্রাফিক সার্জেন্ট। এই একটা সিগন্যালের জন্য গাড়ির সারি দীর্ঘ হয়ে দেওয়ানহাট পর্যন্ত চলে আসে। পরে আগ্রাবাদ অভিমুখে গাড়ি চলাচল করে চাপ কমলে পুনরায় সিগন্যাল খুলে দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করেছেন ট্রাফিক সদস্যরা। তবে রাস্তার মধ্যবর্তী অংশে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলমান থাকার কারণে দুইপাশে কোন গাড়িই ভালভাবে চলতে পারছে না। অল্প গতি দিয়েই গাড়ি চালাচ্ছেন চালকরা। রাস্তায় খানাখন্দ থাকা, কিছুদূর পর পর গর্ত, আবার দুথপাশের মধ্যে একপাশ ব্লক থাকার কারণে যাত্রীদেরও ইপিজেড, সিমেন্ট ক্রসিং, সি-বিচ বা বিমানবন্দর যেতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
সি বিচ থেকে টাইগার পাস আসা যাত্রী মো. সাইফুল ইসলাম জানান, সি বিচ থেকে টাইগার পাস আসতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। অথচ পুরো পথটা ২০ থেকে ২৫ মিনিটের। রাস্তার অবস্থাও তেমন ভাল না। ফ্লাইওভারের কাজ করতে গিয়ে যান চলাচলের রাস্তায়ও গর্ত করা হয়েছে। তাই চালকরাও ঠিকমত গাড়ি চালাতে পারছেন না। আর আমাদেরও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার তারেক আহমেদ জানান, শেখ মুজিব রোডে যাত্রীদের একটু বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়ের কাজের পাশাপাশি ওয়াসার পাইপ লাইন নির্মাণের কাজ চলছে, আবার বৃষ্টি হলে গর্তে পানি জমে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। এসবের মধ্যেও ট্রাফিক সদস্যরা থেমে নেই। এ এলাকায় দ্বিগুণ শ্রম দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ট্রাফিক সদস্য রেখেছি, যাতে যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে না হয়। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের কাজ হয়ে গেলে বর্তমান যে চাপ রয়েছে তা অনেকাংশে কমে আসবে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বন্দর বিভাগের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা জানান, এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলমান থাকায় অনেক সময় রাস্তার একপাশ বন্ধ রেখে অন্যপাশ দিয়ে যান চলাচল করতে হয়। আগাম কোন ঘোষণা না দিয়ে শ্রমিকরা গাড়ি চলাচলের রাস্তার উপর কাজ করা শুরু করে। আবার সড়কের মাঝখানে কাজ করতে করতে যান চলাচলের পথে গর্ত তৈরি করে ফেলে। তবে সাময়িক হলেও তা আর ভরাট করে না। এসব কারণে মূলত জটটা লেগে যায়। আমার আওতাধীন ইপিজেড এলাকায় যানজটের প্রবণতা একটু বেশি। এসবের পরেও আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। যান চলাচল স্বাভাবিক রেখে মানুষের ভোগান্তি লাঘবের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
জানা গেছে, ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ের মোট পিলার হবে ৩৮৯টি, যার মধ্যে ২৩০টির কাজ শেষ হয়ে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস পর্যন্ত চলে এসেছে। পতেঙ্গা থেকে কাটগড় পর্যন্ত এলাকায় গার্ডার এবং স্ল্যাব বসে গেছে।
এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প মতে, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির র্যাম্প ও লুপসহ মোট দৈর্ঘ্য হবে ২০ কিলোমিটার। চার লেনের এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রশস্ততা হবে ৫৪ ফুট। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ৯টি এলাকায় ২৪টি র্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) থাকবে। নগরীর টাইগারপাসে চারটি, আগ্রাবাদে চারটি, বারিক বিল্ডিং মোড়ে দুটি, নিমতলা বিশ্বরোড মোড়ে দুটি, কাস্টমস মোড়ে দুটি, সিইপিজেডে চারটি, কর্ণফুলী ইপিজেডে দুটি, কাঠগড়ে দুটি, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় দুটি র্যাম্প থাকবে। চার ধাপে প্রকল্পের কাজ হওয়ার কথা। এরমধ্যে লালখান বাজার থেকে বারিক বিল্ডিং, বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে সল্টগোলা ক্রসিং, সল্টগোলা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং, সিমেন্ট ক্রসিং থেকে সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে কাজ হওয়ার কথা। বাস্তবায়ন সংস্থা শেষ ধাপ থেকে শুরু করে বর্তমানে চারটি ধাপেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। চারটি ধাপের কাজ একসাথে চলমান আছে। আশা করছি, ২০২৩ সাল থেকে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে।
জানা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হচ্ছে নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কের ওপর দিয়ে। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এ কাজ এগিয়ে আসছে উত্তরের দিকে, যা থামবে লালখান বাজার এলাকায়। টাইগারপাস থেকে লালখান বাজার চট্টগ্রামের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন স্থান হওয়ায় এ অংশটুকু উন্মুক্ত রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন নগরবিদদের কেউ কেউ। সে অনুযায়ী পতেঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হওয়ার কথা ছিল টাইগারপাসের দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ প্রান্ত থেকে। কিন্তু সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা এসে মিলছে লালখান বাজার এলাকায় আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে।
প্রসঙ্গত, নগরীর যানজট নিরসনে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। অনুমোদনের দেড় বছর পর ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটির পিলার পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। তখন ২০২০ সালের মধ্যেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে তিন কিলোমিটার অংশের অ্যালাইনমেন্ট নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে জটিলতা তৈরি হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। পরে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটির নির্মাণকাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ম্যাক্স-র্যানকিন জয়েন্ট ভেনচার।