নিজেস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) গাজীপুর শাখা এখন কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী ও বহিরাগত দালাল সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। দালাল সিন্ডিকেট ও অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী ধারায় পরিচালিত হয় বিআরটিএ গাজীপুর শাখার সকল কার্যক্রম। মোটরযান পরিদর্শক অহিদুর রহমানের সকল অবৈধ কাজের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তার নির্ধারিত দালাল। ড্রাইভিং লাইসেন্স এর জন্য লিখিত পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ খাতা ইন্সপেক্টরের দেখার কথা থাকলেও খাতা দেখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তার নির্ধারিত দালাল।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে গাজীপুর বিআরটিএর অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। এতে দেখা যায় কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী ও বহিরাগত দালালদের সমন্বয়ে এক বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এই সিন্ডিকেটেই নিয়ন্ত্রণ করে বিআরটিএ গাজীপুর শাখার সকল কার্যক্রম। অফিসের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী থেকে শুরু করে অফিসের ইন্সপেক্টর সহ সকলের যোগসাজশে চলে এই দালালি কর্মকান্ড।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিআরটিএ গাজীপুর অফিসে সেবা নিতে আসা সকল প্রার্থীদের অফিসের চাহিদামত দালালের মাধ্যমে ঘুষ প্রদান করলেই মেলে কাক্ষিত সেবা। আর এই দালালদের রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু নামের সংকেত। এই সংকেত দিয়েই চলে পাশ ফেল ও আর্থিক লেনদেনের হিসাব নিকাশ।
দালালদের নামের সংক্ষিপ্ত সংকেতিক চিহ্ন যেমন, এফ এম মানে ফাহিম, আর এক্স মানে রুহুল, কেটিএল মানে কবির, কেএ মানে কাজল, জেইউ মানে জসিম, এসটি মানে শফি, টিও মানে তোফা, আরটি মানে রতন এমন আরও বহু সংকেত রয়েছে দালালদের নামে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স এর জন্য পরীক্ষার্থীদের রোল নং এর যে নির্ধারিত শীট রয়েছে সেখানে যে দালালের যে রোল নং রয়েছে সেই রোলের পাশে সকালেই এই সংকেত বসিয়ে দেওয়া হয়। এরপর লিখিত পরীক্ষা শেষে এই সংকেত ধরেই পাশ ফেল নির্ধারণ করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিআরটিএ এর দুই দালাল শান্তকে পনেরো এবং ছাত্তারকে বিশ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট। সেসময় দালাল শান্ত পনেরো দিন কারাবাস ভোগ করে আবার তার রাজত্বে ফিরে আসে। শান্ত গ্রেফতারের পর পরবর্তী পরীক্ষার যে বোর্ড হয়েছে সেখানে একসাথে অনেক লাইসেন্স প্রত্যাশীকে ফেল করিয়ে দেয়া হয়।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল গাজীপুর বিআরটিএ লিখিত পরীক্ষা কেন্দ্র গিয়ে দেখা যায়, দালাল শান্ত এবং লিমন ড্রাইভিং লাইসেন্স লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখছেন। এসময় শান্ত এবং লিমনকে প্রশ্ন করা হলে তারা দৌড়ে পালিয়ে যায়। জেলা প্রশাসকের ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল খাটা একজন দালাল এভাবে বসে এমন গুরুত্বপূর্ণ খাতা দেখে এটা প্রশ্ন থেকে যায়।
গাজীপুর বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে প্রথমে অনলাইনের মাধ্যমে লার্নার কার্ড করে নির্ধারিত তারিখে বিআরটিএ ইন্সপেক্টর অহিদুর রহমানের উপস্থিতিতে গাজীপুর বিআরটিএ এর ড্রাইভিং লাইসেন্স এর খাতা দেখছেন দালাল লিমন। গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে দৌড়ে পালিয়ে যায় লিমন।
ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে নিয়ম অনুযায়ী লিখিত, মৌখিক ও সরেজমিন পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষায় ২০ নাম্বারের লিখিত প্রশ্ন থাকে যার থেকে ১২ নাম্বার পেলেই পাশ। তবে সবথেকে বড় হয়রানি এখানেই শুরু হয়। দালালের মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে আসলে লিখিত পরীক্ষায় কোনমতো লিখতে পারলেই পাশ দিয়ে দেওয়া হয়। আর যেসব সেবা প্রার্থীরা দালাল ছাড়া আসে তাদের ফেল করিয়ে দেওয়া হয়। মোটকথা গাজীপুর বিআরটিতে সকল সেবার একমাত্র উপায় দালালদের মাধ্যমে টাকা দিলেই পাস। আর এসব দালালের মাধ্যমে গাজীপুর বিআরটির অসাধু কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। শুধুমাত্র বাহিরের দালাল নয় অফিসের কর্মচারীরাও এসব দালালির সাথে যুক্ত রয়েছে। এই অফিসের একজন কর্মচারী মেকানিকাল এসিস্ট্যান্ট শেখ মো:আদিয়াত হোসেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাকরির প্রথমেই তিনি গাজীপুরের মতো জায়গায় যোগদান করেছেন। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক দালাল বলেন, আদিয়াতে কথা হলো যত টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন তত টাকা তিনি গাজীপুর থেকে নিয়ে যাবেন। পেশাদার লাইসেন্স নবায়নে দালালির সঙ্গে সরাসরি তিনি যুক্ত রয়েছে। নির্ধারিত ঘুষের টাকা দিলে সব কাজ করে দেন তিনি। আরও অভিযোগ রয়েছে পেশাদার লাইসেন্স নবায়নে তার সাথে চুক্তি করলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করলেও পাশ করিয়ে দেন। এছাড়াও নতুন মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন করতে তাকে ঘুষ দিতে হয় ২ থেকে তিন হাজার টাকা। পাশাপাশি অনান্য গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন এর জন্যও তাকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। তার এসব ঘুষ বাণিজ্য থেকে কেউ রেহাই পায়না।
অফিসের উচ্চমান সহকারী মোঃ শাহ আলম মোটরযান পরিদর্শক অহিদুর রহমানের সকল অনিয়মে সহযোগিতা করেন। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে দেয়া এবং ঘুসের টাকা বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব রয়েছে এই কর্মচারীর কাছে। হরহামেশাই শোনা যায়, গাজীপুরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সাথে তার সখ্যতা রয়েছে। সেজন্য সে কোন কিছুর তোয়াক্কা করে না। শুধুমাত্র এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, বাহিরের আর একজন দালাল রয়েছে শামীম। তার মাধ্যমে গ্রাহকের ড্রাইভিং লাইসেন্স স্মার্ট কার্ড
ডেলিভারি দেয়া হয়। সে প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে লাইসেন্স ডেলিভারিতে ৫০০ টাকা নিয়ে থাকে। পরবর্তীতে এই টাকার ভাগ অফিস প্রধানকে বুঝিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর বিআরটিতে প্রতি সপ্তাহে দুটি করে ড্রাইভিং লাইসেন্স এর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ২০০ জন প্রার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সে হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় ১৬০০ প্রার্থী অংশগ্রহণ করে। হিসেব মতে এসব প্রার্থীর মধ্য থেকে প্রায় ১২০০ সেবা প্রার্থীর কাছ থেকে মাসে প্রায় ২৪ লাখ টাকার মতো দালালের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় মোটরযান পরিদর্শক অহিদুর রহমান। পরে সেই টাকার ভাগ আটোয়ারা হয়।
পরিদর্শক অহিদুর রহমানের নিকট সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা নিউজ করেন আমাকে সরিয়ে দেন, তবে তিনি সকল বিষয়ে এড়িয়ে যান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক আবু নাঈম বলেন, পরীক্ষার বোর্ডে বাহিরের লোক দিয়ে কাজ করিয়ে ইন্সপেক্টর মহা অন্যায় করেছে। আমি ইন্সপেক্টর অহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা করবো, এই ঘটনার পর তাকে লিখিত পরীক্ষার কার্যক্রম থেকে সরিয়ে দিয়েছি।