টঙ্গীর তুরাগপাড়ের বিশ্ব ইজতেমাস্থল দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির পদচারণায় মুখর হয়েছিল এবারও। শিল্পনগরী টঙ্গী যেন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছিল। এবারের ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন গতকাল শনিবার আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত তরিকা অনুযায়ী জীবন গড়ার আহ্বান জানিয়ে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান।
আজ রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব।
আয়োজক কমিটি জানায়, বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ২৫-৩০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি এতে অংশ নেবেন। বিশেষভাবে স্থাপিত মঞ্চ থেকে এ মোনাজাত পরিচালনা করা হবে। এর আগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়তি বয়ান। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে আগামী শুক্রবার শুরু হবে তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। আগে এক পর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলেও ২০১৫ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমার আয়োজন করা হচ্ছে।সরেজমিন দেখা যায়, আখেরি মোনাজাতে মুসল্লিদের আসা ও যাওয়া নিরাপদ করতে শনিবার মধ্যরাত থেকে মোনাজাতের সময় পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানগামী সড়কে যানবাহন চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে পুলিশ। মাঠে বিন্দুমাত্র জায়গা না থাকা সত্ত্বেও এখনো আসছেন মানুষ। গতকালও টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। ধারণা করা হচ্ছে, মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে।
এদিকে এবারও তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বিরা রেডিও-টিভিতে আখেরি মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচারের অনুমতি দেননি। মুরুব্বিদের ছবি তোলাও বারণ করে দিয়েছে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ।যৌতুকবিহীন বিয়ে : বিশ্ব ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ যৌতুকবিহীন বিয়ে। শরীয়ত মেনে তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ী ইজতেমার দ্বিতীয় দিন শনিবার বাদ আসর যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর বসে। শতাধিক বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এ আসরে। ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাসান এসব বিয়ে পড়ান। গত কয়েক বছর এটি অনুষ্ঠিত হয়নি।
ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা : গতকাল শনিবার সকাল থেকে ইজতেমা ময়দান সংলগ্ন ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্পগুলোতে মুসল্লিদের চিকিৎসা নিতে ভিড় দেখা গেছে। অসুস্থদের অধিকাংশই ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, আমাশয়, শ্বাসকষ্টের রোগী।
বিশেষ ট্রেন : বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ে আখাউড়া, কুমিল্লা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে ২১টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে।
৭ মুসল্লির মৃত্যু : ইজতেমায় এ পর্যন্ত সাত মুসল্লির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শুক্রবার বিকেলে ও রাতে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। গতকাল শনিবার ফজরের নামাজের পর ইজতেমা ময়দানে তাদের জানাজা সম্পন্ন হয়। এর আগে আরও চারজন মুসল্লি মারা যান।
ইজতেমা ময়দানে মৃত মুসল্লিরা হলেন সিলেটের হরিপুরের হেমুবটে পাড়া গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে নূরুল হক, গাজীপুরের ভুরুলিয়া এলাকার আবু তৈয়ব ওরফে আবু তালেব, ঢাকার কেরানীগঞ্জের হাজী মোহাম্মদ হাবিবউল্লাহ হবি, ঢাকার কেরানীগঞ্জের মলমলিয়া গ্রামের মোবারক হোসেন খানের ছেলে মোফাজ্জেল হোসেন খান, মুন্সীগঞ্জের মধ্য কামাল গ্রামের আদিল উদ্দিন সিকদারের ছেলে আক্কাছ আলী সিকদার, চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের আব্দুল রশিদের ছেলে আব্দুল রাজ্জাক ও নরসিংদী জেলার মাছিমপুর গ্রামের রহমত উল্লার ছেলে হাবিবুর রহমান হবি।
ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী মুরুব্বি জহির ইবনে মুসলিম জানান, ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মধ্যে বার্ধক্য জনিত ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে এ পর্যন্ত সাতজন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।
অস্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রির অপরাধে জরিমানা : বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন গতকাল শনিবার গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৫টি অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানে ১৪ মামলায় ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা ও আদায় করা হয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনিসুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়।
আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বাড়তি নিরাপত্তা : গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম জানান, বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর পুলিশ প্রশাসন বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। ট্রাফিক বিভাগও মুসল্লিদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত ও সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে ট্রাফিক বিভাগকে।
আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর কাকরাইল জামে মসজিদে প্রথম বিশ্ব ইজতেমার প্রচলন শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। এরপর ১৯৪৮ সালে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে। ১৯৫৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৬৬ সাল থেকে গাজীপুরের শিল্প নগরী টঙ্গীর তুরাগ তীরে এ জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।