কবি রোকনুজ্জামান খানের “হাসি ” কবিতার প্রথম চারটি লাইন-
” হাসতে নাকি জানেনা কেউ
কে বলেছে ভাই?
এই শোনো না কত হাসির
খবর বলে যাই । ”
আজকের লেখা শুরু করছি হাসির খবর দিয়েই। হাসিমাখা মুখ, হাসিতে ভরা প্রকৃতি, গাছগাছালির ছায়াতে হাসি, মেঘনা নদী থেকে ভেসে আসা বাতাসে হাসির শব্দ, আকাশে হাসির রংধনু, কোমল নরম বাতাসে প্রতিনিয়ত হাসিতে দোল খাচ্ছে কত রং বেরঙের নাম জানা -অজানা ফুল। কাঁঠালের হাসি মাখানো রিষ্ট পুষ্ট দেহ, কৃষ্ণ চূড়া গাছের আগুন ঝরা হাসি, মাটির গন্ধে হাসি, সবুজ মাঠে ছড়ানো বিছানো হাসি, আম গাছের কাঁচা আমের গন্ধে হাসি, পাখির হাসি, গাছের হাসি — শুধু হাসি আর হাসি।
রাস্তার উভয় পাশে বিশালাকার রেইনট্রিগুলো সারিবদ্ধ ভাবে সুশৃংখল হয়ে হাসিমুখে মৃদুমন্দ হাওয়া যোগান দিয়ে ছায়ার চাদরে ঘিরে রেখেছে ক্যাম্পাসের অনেকগটা অংশ। সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ গুলোকে দেখলে মনে হবে দেশ সেরা চৌকস বুদ্ধিদীপ্ত মেহমানদের হাসি ফুলের মালা উপহার দিয়ে বরণ করতে আর ভালোবাসার আদরে ভরা অভিজ্ঞতার ঝুলি উপহার দিয়ে দেশের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ার বার্তা দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে।
গত ১৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে
সারা বাংলাদেশ থেকে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন Accelerating and Strengthening Skills for Economic Transformation (ASSET) প্রকল্পের গ্র্যান্ট প্রাপ্ত ১২টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ৫ টি নার্সিং ও ১টি ম্যাটস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩০ জন প্রশিক্ষনার্থীদের মধ্যে গাজীপুরের স্বনামধন্য বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মডেল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) গাজীপুর থেকে আমি ও প্রফেসর ডক্টর হায়দার আলম স্যার “3- week training on public procurement & e- Gp management ” প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ কলেজ, বাংলাদেশ, চর বাউশিয়া, গজারিয়া মুন্সিগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিরতিহীন ছোট বড় গাড়ির যথারীতি ভয়ংকর প্রতিযোগিতার শো শো শব্দ,অনবরত ভেপুর হুমকি, পুলিশের গাড়ির, অ্যাম্বুলেন্সের গলা ফাটা চিৎকার ভেদ করে যখন গজারিয়া মুন্সিগঞ্জ ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ কলেজ বাংলাদেশে এ প্রবেশ করি, মুহূর্তেই প্রায় শতাধিক রেইনট্রি গাছের অপার সৌন্দর্য ও ময়ূরের পেখমের মতো গাছগুলোর ডালা পালা কে মেলে ধরার দৃশ্য দেখে রীতিমতো অবাক ও মনের অজান্তেই একটা স্বস্থিবোধ করি। ভ্রমণের ক্লান্তি কখন কিভাবে দূর হয়ে গিয়েছিল বলতে পারবো না।
যাইহোক মিষ্টি মিহি গলার নরম সুরের হাস্যজ্জল গাইড এর সাহায্যে তড়িঘড়ি করে নির্ধারিত রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ নাস্তা সেরে সকাল ৯ টা বাজার কয়েক মিনিট আগেই ওপেনিং সেশনে অংশগ্রহণ করলাম। প্রথম ব্যতিক্রমধর্মী হাসির দেখাটা মেলে নির্বাহী অফিসার (হেড অফ কোর্স) প্রকৌশলী আব্দুল আউয়াল স্যারের চোখেমুখে। ট্রেনিং শেষ হওয়া অবধি তার হাসিটা অপরিবর্তিত ছিল। কথা বলার আগে হাসে, কথা বলার মাঝখানে হাসে এবং কথা বলার শেষেও হাসি মাখা মুখ নিয়ে বিদায় নিতো সব সময়। ওপেনিং সেশনে পিডি স্যার ( মীর জাহিদ হাসান, অতিরিক্ত সচিব) সহ সম্মানিত সভাপতি ও বিশেষ অতিথি বৃন্দের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা পূর্ণ বক্তব্যে কোন কৃত্রিমতা ছিল না। প্রত্যেকেই হাসিমাখা মুখে নরম সুরে ট্রেনিং প্রোগ্রামের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছিল ক্লোজিং সিরিমনি অনুষ্ঠানে পিডি স্যার যখন হেসে আওয়াল স্যার কে বলেছিলেন সবাইকে নদীর মাছ খাওয়ান তো? কারণ মেঘনা নদীর পাড়েই তো আমাদের ক্যাম্পাস। তার কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল পরিবারের প্রধান তার সন্তানদের খোঁজখবর নিচ্ছেন।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি, প্রথমদিন ক্লাস থেকে ফিরে দেখি রুমের সকল কাজকর্ম গুছিয়ে ফিটফাট করে রাখা হয়েছে। আমি কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। রুমের চাবি তো আমার কাছে। কেউ রুমে ঢুকবে অফিস থেকে আমাদেরকে তো জানানো হলো না। অন্তত টাকা, মানিব্যাগ সাথে নিয়ে যেতাম। যাইহোক চেক করে দেখলাম সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে। তিন সপ্তাহের ট্রেনিং এ একটা সুতাও মিসিং হয়নি অথচ তারা প্রতিদিন আমাদের অনুপস্থিতিতে রুমের সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখে যেত মনে হতো আমরা পরিবারের সাথেই বসবাস করছি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম সেখানকার স্টাফরা শুধু হেসে হেসে কথা বলে না এরা সৎ এবং লোভী না তাতে কোন সন্দেহ নেই। ডাইনিং এ খেতে গেলে লক্ষ্য করতাম ক্যান্টিনের সুন্দর নিষ্পাপ চেহারার ছেলেগুলো কখনো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না,জোড়ে শব্দ করে কথা বলে না, চুপচাপ চটপট করে সব কাজ করে ফেলতো। এত শৃঙ্খলা, এত আদব কায়দায় এরা কোথায় শিখলো?প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আমরা কুমিল্লার ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে গিয়েছিলাম। সাথী ছিল ল্যাব এটেনডেন্ট আলামিন এবং প্রতিষ্ঠানের বাসের ড্রাইভারের চোখে মুখে অসম্ভব রকমের ব্যক্তিত্ব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। ক্যাম্পাসের মসজিদের ইমাম সাহেবের সহজ সরল হাস্যোজ্জ্বল সালাম বিনিময় প্রশংসনীয়। প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের সবচেয়ে বেশি যাকে পেয়েছি, বিভিন্ন প্রয়োজনে যাকে ডাকলেই কাছে পাওয়া যেত আলামিন সম্পর্কে প্রকৌশলী আউয়াল স্যার যা বললেন — আলামিনকে কখনো আমার অধস্থন মনে করি না। কাছে ডাকি পরামর্শ করি এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ভালোবাসা। ভালোবাসার কাছে সবাই পরাজিত। ভালোবাসা এবং নিয়মকানুনের জন্যই আমাদের স্টাফ কলেজের ভেতরের পরিবেশটা এত সুন্দর এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সকলেই সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিজ নিজ কার্য সম্পাদন করে। তিনি আরো জানালেন, আমাদের আজকের এই সফলতা অর্জন এর অন্যতম কারিগর ও মহানায়ক হচ্ছেন অত্যন্ত সৎ ও বিজ্ঞ প্রকৌশলী অধ্যাপক এম এ হান্নান স্যার যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ কলেজের প্রথম রেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা সবকিছুই আমাদের এই সফলতার পেছনে রয়েছে।
বন্ধুসুলভ আচরণে প্রায় সকল রিসোর্স পারসন গণ ক্লাস নিতেন। হাসিমাখা মুখ সকলের মাঝেই কমন ছিল। কেউ কেউ আবার হেসে হেসে হেলে দুলে ও ক্লাস নিয়েছেন, গল্পগুজব করে আমাদের মনোযোগ কে আকৃষ্ট করতেন। আমরা কেউ কেউ অবুঝের মত প্রশ্ন করলেও রাগ করতেন না, হেসে হেসেই ধৈর্য নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতেন।
দীর্ঘদিন স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ কলেজের ট্রেনিং প্রোগ্রামের দিনগুলো। ৭২ বিঘা ক্যাম্পাসের একপাশে মেঘনা নদী, আরেক পাশে বিশাল বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ ও অন্য পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। মেঘনা নদীর মৃদুমন্দ হাওয়া ও প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের কাছে মহাসড়কের উপর দানব গাড়িগুলোর শো সো বিকট শব্দ ও ম্লান হয়ে গিয়েছিল, মোটেও বিরক্ত লাগেনি।
আমার লেখার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, যে দেশে আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, কথায় কথায় মিথ্যা কথা বলি, ঘুষ না হলে কোন কাজ হয় না, ভালো ব্যবহার করতে ভুলেই গেছি, সেখানে স্টাফ কলেজের প্রশাসন সত্যিই অনুকরণীয়। মহানবী (সা:) এর অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও ব্যক্তিত্ব ধারণ করে সবাইকে হতে হবে বিনয়ী। আনুগত্য, সহযোগিতা, পারস্পরিক সুসম্পর্ক, জনসেবা ও জনকল্যাণ মূলক কাজ হোক আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যারা প্রশিক্ষণ নিতে আসেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়বেন। অন্ততপক্ষে আপনাদের দ্বারা কোন প্রকার অনিয়ম হবে না। ভালোবাসা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন এই প্রত্যাশাই রইল।
মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
উপাধ্যক্ষ
মডেল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি( এম আই এস টি), গাজীপুর।